খাদ্য মানব দেহের শক্তির প্রধান উৎস। খাদ্য ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষ কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল, শস্য গ্রহণের পাশাপাশি রান্না করা খাবারের প্রতি নির্ভরশীল। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ রান্না করা খাবার বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে থাকে। কেউ দুই বেলা আবার কেউ তিন থেকে চার বেলা রান্না করা খাবার খেয়ে থাকে। আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের রান্নার ধরন বদলেছে। দিনে দিনে মানুষের রান্নার ধরন আরো উন্নত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের খাবার রান্নায় বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে ডিজিটাল চুলা বা কুকার। যেগুলো ইলেকট্রিক চুলা বা কুকার হিসেবে পরিচিত। এই কুকার গুলোতে খুব সহজে ঝামেলা হীন ভাবে খুব কম সময়ে রান্না করা যায়। এসব কুকারে রান্না করা যেমন সহজ তেমনি রান্নার গুনাগুন ও থাকে অপরিবর্তনশীল। এই ধরনের ইলেকট্রিক চুলা বা কুকার গুলোতেও রয়েছে ভিন্নতা। কোনোটিতে রয়েছে ম্যাগনেটিক কয়েল। যাকে বলা হয় ইন্ডাকশন কুকার বা চুলা। আর কোনোটিতে রয়েছে ইনফ্রারেড রশ্মি। যাকে বলা হয় ইনফ্রারেড কুকার বা চুলা। এই আর্টিকেলে আমরা ইন্ডাকশন চুলা ও ইনফ্রারেড চুলার পার্থক্য, কোন চুলা আপনার জন্য উপযুক্ত এবং এগুলোর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করব।
ইন্ডাকশন কুকার বা চুলা
ইন্ডাকশন চুলা মূলত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে রান্নার পাত্রকে গরম করে। পরে পাত্র থেকে রান্নায় তাপ পরিবাহিত হয়। ইন্ডাকশন বলতে তাপ বা হিট তৈরীর এক প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। পুরনো দিনের স্টোভ গুলো যেখানে রেডিয়ান পদ্ধতিতে তাপ পরিবহন করে সেখানে ইন্ডাকশন কুকার ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক প্রক্রিয়া তাপ পরিবহন করে। এটি এমন এক ধরনের বৈদ্যুতিক রান্নার যন্ত্র যা সরাসরি পাত্রের নিচে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে পাত্রকে গরম করে, ফলে দ্রুত ও কার্যকরভাবে রান্না করা যায়। এটি প্রচলিত গ্যাসের চুলা বা হিটিং এলিমেন্টের চেয়ে দ্রুত তাপ উৎপন্ন করে। এই চুলায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ এবং নিরাপদ, কারণ এর বাইরের পৃষ্ঠ খুব বেশি গরম হয় না। এটি শক্তি সাশ্রয়ী এবং এতে ডিজিটাল ডিসপ্লে, অটো শাট-অফ, ওভারহিট প্রোটেকশন ও বিভিন্ন রান্নার মোডের মতো আধুনিক সুবিধা ও ফিচার থাকে, যা রান্নাকে সহজ ও স্মার্ট করে তোলে।
ইন্ডাকশন চুলার সুবিধা
১. দ্রুত রান্না: ইন্ডাকশন চুলা অন্যান্য সাধারণ চুলার থেকে দ্রুত গরম হয়
বিধায় এ ক্ষেত্রে এনার্জি কম খরচ হয় এবং তাপ দ্রুত খাবারে পৌঁছায়। ফলে এই
চুলায় প্রচলিত চুলার চেয়ে অনেক দ্রুত খাবার রান্না করা যায়।
২. সময় সাশ্রয়: ইন্ডাকশন চুলায় রান্নায় অন্যতম সুবিধা হল এই চুলা
অত্যন্ত সময় সাশ্রয়ী। এই চুলা সাধারণ চুলার চেয়ে ৪০%-৫০% কম সময়ে রান্না করতে
সক্ষম।
৩. তাপ নিয়ন্ত্রণ: ইন্ডাকশন চুলা থেকে আগুন লেগে যাওয়ার ভয় নেই
আর এর হিট সহজে নিয়ন্ত্রণ করার অপশন রয়েছে। এই চুলার তাপ সহজে নিয়ন্ত্রণ করা
যায়।
৪. সহজ ব্যবহার: ইন্ডাকশন চুলা ব্যবহার করা সহজ। কোনো ধরনের ঝামেলা নেই।
এতে রান্নার সময় নির্ধারণ করা যায়।
৫. বিদ্যুৎ সাশ্রয়: এই চুলায় বিদ্যুৎ বিল মোটামুটি ধরনের আসে। মাসিক
হিসেবে যা সাধারণ গ্যাসের চুলা থেকে অনেক কম। আর এই চুলায় তাপ অপচয় কম হয়, ফলে
বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়।
৬. উচ্চ শক্তি দক্ষতা: এই চুলা খুব দ্রুত গরম হয় তাই সহজে রান্না করা
যায়।
৭. নিরাপত্তা: চুলা নিজে সরাসরি গরম হয় না, শুধু পাত্র গরম হয়, তাই
দুর্ঘটনা কম হয়।
৮. সহজ পরিষ্কার: উপরিভাগ মসৃণ কাচের তৈরি হওয়ায় পরিষ্কার করা সহজ।
|
| Image: ইন্ডাকশন ইন্ডাকশন কুকার |
ইন্ডাকশন চুলার অসুবিধা
১. ব্যয়বহুল: ইন্ডাকশন চুলা সাধারণ চুলার তুলনায় ব্যয়বহুল। এটি
ইন্ডাকশন চুলার প্রধান অসুবিধা। তাছাড়া এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পাত্র কিনতেও
অতিরিক্ত খরচ হতে পারে।
২. বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অকার্যকর: বিদ্যুৎ নির্ভর হওয়ায় বিদ্যুৎ বিহীন
এলাকায় অথবা অতিমাত্রায় লোডশেডিংয়ে এটি ব্যবহার করা দুর্ভোগের কারণ হতে পারে।
৩. হালকা আওয়াজ: ইন্ডাকশন চুলায় এক ধরনের সফট আওয়াজ হয় যা অনেকের সহ্য
নাও হতে পারে।
৪.পাত্রের সীমাবদ্ধতা: ইন্ডাকশন চুলায় সব ধরনের হাড়ি-পাতিল বা
হান্ডি ব্যবহার করা যায় না। শুধুমাত্র ইন্ডাকশন-উপযোগী (চৌম্বকীয়) পাত্র, যেমন
স্টেইনলেস স্টিল বা কাস্ট আয়রনের পাত্র ব্যবহার করতে হয়।
৫. দ্রুত গরম হওয়া: ইন্ডাকশন চুলায় রান্নার জন্য আগে থেকে রান্নার
সামগ্রী (তরি-তরকারি) প্রস্তুত করে রাখতে হয়। এটি খুব দ্রুত গরম হয় এবং
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে, ফলে ভুলবশত খাবার পুড়ে যেতে
পারে।
৬. ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাথে জটিলতা: এর চৌম্বক ক্ষেত্র কিছু ডিজিটাল
থার্মোমিটারের মতো সংবেদনশীল ইলেকট্রনিক যন্ত্রের কার্যকারিতায় বাধা দিতে পারে।
৭. দ্রুত তাপহীন হওয়া: ইন্ডাকশন চুলায় বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে সাথে তাপ চলে
যায়।
ইনফ্রারেড কুকার/চুলা
ইনফ্রারেড চুলা/কুকার পাত্রকে হিট করতে ইনফ্রারেড রশ্মি (Infrared Radiation) ব্যবহার করে। পরে পাত্র থেকে রান্নায় তাপ পরিবাহিত হয়। পুরনো দিনের চুলা গুলো যেখানে রেডিয়েন্ট পদ্ধতিতে তাপ পরিবহন করে সেখানে ইনফ্রারেড কুকার ইনফ্রারেড রে (রশ্মি) ব্যবহার করে পাত্রে তাপ পরিবহন করে। এটি গ্যাস বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ছাড়াই তাপ উৎপন্ন করে ফলে যেকোনো ধরনের পাত্র (ধাতব, সিরামিক, কাঁচ) ব্যবহার করা যায়, এটি ইন্ডাকশনের চেয়ে ভিন্ন এবং সহজে যেকোনো পাত্রে কাজ করে, দ্রুত ও সমানভাবে তাপ দেয়।
ইনফ্রারেড চুলার সুবিধা
১. সব ধরনের পাত্র ব্যবহার: ইনফ্রারেড কুকার ইন্ডাকশন চুলার মতো
নির্দিষ্ট ম্যাগনেটিক পাত্রের উপর নির্ভরশীল নয়; তাই অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল,
সিরামিকসহ যেকোনো পাত্রে রান্না করা যায়, যা বাড়তি খরচ কমায়। অর্থাৎ, ইনফ্রারেড
কুকারে সব ধরনের হাড়ি-পাতিল ব্যবহার করে রান্না করা যায়।
২. দ্রুত রান্না:
এই চুলা ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে পাত্রে সরাসরি তাপ দেয়, ফলে দ্রুত রান্না করা
যায় ।
৩. শক্তি সাশ্রয়: এই কুকার গ্যাস বা প্রচলিত চুলার তুলনায়
বেশি কার্যকর, কারণ এটি কম জ্বালানি বা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং বেশি তাপ উৎপন্ন
করে।
৪. পরিবেশ রক্ষা ও কম তাপ উৎপাদন: ইন্ডাকশন চুলার মতো
ইনফ্রারেড চুলা পরিবেশকে অতিরিক্ত গরম করে না এবং সরাসরি পাত্রে তাপ দেয় । ফলে
রান্নাঘরের পরিবেশ ঠান্ডা থাকে।
৫. সহজে পরিষ্কারযোগ্য: এর উপরিভাগ
মসৃণ ও সমতল পৃষ্ঠ হওয়ায় সহজেই মুছে পরিষ্কার করা যায়, যা রক্ষণাবেক্ষণ সহজ করে
তোলে।
৬. স্বাস্থ্যসম্মত: এটি বাতাসের সংস্পর্শে না এসে সরাসরি
খাবার গরম করে, ফলে খাবারে ধুলোবালি ও জীবাণু ছড়ানোর ঝুঁকি কম থাকে এবং খাবার তার
আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে।
৭. হালকা ও বহনযোগ্য: রান্নাঘর, RV,
ক্যাম্পিং বা ছোট জায়গায় ব্যবহারের জন্য এটি সুবিধাজনক, কারণ এটি হালকা ও খুব
সহজে বহনযোগ্য।
৮. কোন কারনে বিদ্যুৎ চলে গেলেও এটি ঠান্ডা হতে দেড় থেকে দুই মিনিট সময় নেয়।
অর্থাৎ, বিদ্যুৎ যাওয়ার পরেও এটি দেড় থেকে দুই মিনিট সচল থাকে।
৯. নিরাপত্তা: ইনফ্রারেড চুলা থেকে আগুন লেগে যাওয়ার ভয় নেই আর
এর হিট সহজে নিয়ন্ত্রণ করা অপশন রয়েছে।
১০. রান্নার সময় নির্ধারণ:
ইনফ্রারেড চুলা ব্যবহার করা সহজ কোনো ধরনের ঝামেলা নেই এতে রান্নার সময় নির্ধারণ
করা যায়।
১১. বিদ্যুৎ সাশ্রয়: মাসিক হিসেবে বিদ্যুৎ বিল মোটামুটি
আসে অন্যান্য সাধারণ চুলা থেকে অনেক কম।
ইনফ্রারেড চুলার অসুবিধা
১. বিদ্যুৎ অপচয়: খুব বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হওয়ায় বিদ্যুৎ অপচয়ের
সম্ভাবনা আছে।
২. ব্যয়বহুল: ইনফ্রারেড চুলা সাধারণ চুলার তুলনায়
ব্যয়বহুল। এটি ইনফ্রারেড চুলার প্রধান অসুবিধা।
৩. বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অকার্যকর:
বিদ্যুৎ নির্ভর হওয়ায় বিদ্যুৎ বিহীন এলাকায় অথবা অতিমাত্রায় লোডশেডিংয়ে এটি
ব্যবহার করা দুর্ভোগের কারণ হতে পারে।
ইন্ডাকশন ও ইনফ্রারেড চুলার মধ্যে পার্থক্য
১. ইন্ডাকশন চুলা খুব তাড়াতাড়ি গরম হয়।
অপরদিকে ইনফ্রারেড চুলা গরম হতে এক থেকে দুই মিনিট সময় নেয়।
২. ইন্ডাকশন চুলা ম্যাগনেটিক হওয়ায় বিদ্যুৎ অপচয় কম হয়।
ইনফ্রারেড বিদ্যুৎ অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
৩. ইন্ডাকশন চুলায় দ্রুত রান্না করা যায়।
ইনফ্রারেড চুলায় সাধারণ চুলার তুলনায় মোটামুটি দ্রুত রান্না করা যায়।
৪. ইন্ডাকশন চুলা বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায়।
ইনফ্রারেড সাথে সাথে বন্ধ হয় না।
৫. ইন্ডাকশন ও ইনফ্রারেড উভয় বিদ্যুৎ নির্ভর হওয়ায় বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় বা
লোডশেডিংয়ে ব্যবহার করা দুর্ভোগের কারণ হতে পারে।
৬. ইন্ডাকশনে সব ধরনের হাড়ি-পাতিল ব্যবহার করা যায় না। নির্দিষ্ট হাড়ি-পাতিল
ব্যবহার করতে হয়। ইনফ্রারেডে ধরনের হাঁড়ি-পাতিল ব্যবহার করা যায়।
৭. ইন্ডাকশন চুলায় বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে সাথে তাপহীন হয়ে পড়ে। ইনফ্রারেড
চুলায় বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে সাথে তাপহীন হয় না। তাপহীন হতে এক থেকে দেড় মিনিট
সময় নেয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা ইন্ডাকশন চুলা ও ইনফ্রারেড চুলার সুবিধা-অসুবিধা, পার্থক্য ভালোভাবে বুঝতে পারি।
কোন ধরনের ইলেকট্রিক চুলা কিনবেন?
কোন ধরনের ইলেকট্রিক চুলা কিনবেন তা নির্ভর করে আপনার প্রয়োজন ও বাজেটের ওপর। মূলত ইন্ডাকশন ও ইনফ্রারেড দুটি জনপ্রিয় ধরন আছে, যেখানে ইন্ডাকশন দ্রুত ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কিন্তু শুধু চুম্বকীয় পাত্রে চলে, আর ইনফ্রারেড যেকোনো পাত্রে চলে এবং বহুমুখী। তবে কেনার আগে ব্র্যান্ড, ওয়াটস ও নিরাপত্তা ফিচার (যেমন অটো শাটডাউন) দেখে নেওয়া জরুরি। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী এই বিকল্পগুলো থেকে বেছে নিতে পারেন। যদি দ্রুত রান্না ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় মুখ্য হয় তবে ইন্ডাকশন চুলা, আর যদি সব পাত্র ব্যবহারের সুবিধা চান তবে ইনফ্রারেড চুলা ভালো হবে।
তথ্য সমৃদ্ধ কন্টেন্ট নিয়মিত পেতে আমাদের ওয়েবসাইট নিয়মিত ভিজিট করুন
ওয়েবসাইট লিংক → WWW.FAIFINITY.COM

.jpg)